মক্কা জাদুঘর:নবী রাসুলদের ব্যবহৃত আশ্চর্য জিনিসপত্র
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ৩ বছরs পূর্বে
আস্সালামু আলাইকুম।
আলহামদুলিল্লাহ, আমরা গতকাল উমরাহ শেষ করে আজ আসছি জিয়ারাহ’ তে। আমাদের গন্তব্য মক্কা জাদুঘর (Makkah Museum Visit) পরিদর্শন। আমাদের টিমে আছি ১৫ জন। মসজিদ-আল-হারম হতে মক্কা মিউজিয়াম এর দুরত্ব মাত্র ৬-৭ কিলোমিটার। কোন ফি ছাড়াই প্রবেশ করতে পারেন মক্কা জাদুঘরে।
মক্কা জাদুঘরের সম্পূর্ণ HD ভিডিও দেখুন :
Main Gate of Makkah Museum
জাদুঘরের গেটে আসছি জাদুঘর পরিদর্শন করার আশায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের। আজ সোমবার; শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য খোলা। সপ্তাহের বাকি দিনগুলোতে পুরুষরা প্রবেশ করতে পারবেন। তো কি আর করা আমাদের কাফেলার মহিলা সদস্যরাই জাদুঘরের ভিতরে প্রবেশ করেন, আর আমরা গেটের বেইরে অপেক্ষা করি।
In Front of Makkah Jadughor
আগের আল-আজহার প্যালেস ‘ টিকে জাদুঘরে রুপান্তর করা হয়েছে, যার আয়তন ৩৪৩৫ বর্গ মিটার। বাদশাহ আব্দুল আজিজ এর নির্দেশে এই জাদুঘর নির্মান কাজ শুরু হয় ১৩৬৫ আরবী হিজরীতে এবং শেষ হয় ১৩৭২ সালে। এখানে সৌদি আরবের প্রাক-ইসলামী ইতিহাসের প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলি প্রদর্শন করা হয়।
এখানে গুরুত্বপূর্ণ চিত্র থেকে শুরু করে নানা ঐতিহাসিক বস্তু সামগ্রীর সংগ্রহ রয়েছে। রয়েছে হরেক রকম ক্যালিওগ্রাফি।
Calligraphy In the Makkah Museum
জাদুঘরের ক্যালিওগ্রাফি
‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’- মক্কা নগরীর পবিত্র কাবা শরীফ বা আল্লাহর ঘর থেকে হেদায়েতের ডাক আসে প্রতিবছরই। লক্ষ লক্ষ মুসলিম হজ্ব মৌসুমে এবং সারা বছর উমরাহ’র উদ্দেশ্যে একত্রিত হয় পবিত্র কাবা শরীফে। হজ্ব এবং উমরাহর মূল আনুষ্ঠানিকতা শেষে মুসল্লিরা অনেকটা সময় পান। এসময় ইবাদতের সাথে সাথে ইসলামিক নানান ঐতিহাসিক স্থানগুলোও দর্শন করতে পারেন।
মসজিদ এ নববীর ডিজাইন
শুধুমাত্র ধর্মপ্রাণ মুসল্লি নয় বরং ভ্রমণপিয়াসু যে কেউই ভ্রমণ করতে পারে পবিত্র মক্কা নগরী। হজ্বে বা ভ্রমণে গেলে ঘুরে দেখতে পারেন মক্কা জাদুঘর। কাবা শরিফের বেশ কাছেই মক্কা জাদুঘর। জাদুঘরটি সকলের জন্য উন্মুক্ত এবং প্রবেশের জন্য কোনো টিকিট কাটা লাগে না।
তবে প্রতি সপ্তাহে সোমবার শুধমাত্র মহিলাদের জন্য খোলা থাকে। তো আমরা এই সোমবারেই এখানে এসে উপস্থিত হয়েছি। যেহেতু বিষয়টি জানা ছিল না তাই শুধমাত্র আমাদের মহিলা সদস্যরাই ভিতরে পরিদর্শনের সুযোগ পায় আর আমরা বাহিরে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না।
দুই তলা বিশিষ্ট মক্কা জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে সৌদি আরবের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী পোশাক–পরিচ্ছদ, আসবাবপত্র, বাদ্যযন্ত্র ইত্যাদি।
তবে এখানে সংরক্ষিত সবকিছুই কাবা কেন্দ্রীক। এছাড়াও রয়েছে প্রাচীন সৌদি আরবে ব্যবহৃত ধাতব মুদ্রার বেশ বড় সংগ্রহশালা।
মূলত মক্কা জাদুঘর কাবা শরিফ ও মসজিদে নববীর বর্তমান রূপের আগে বিশেষ করে তুর্কি আমলের ব্যবহৃত জিনিপত্রের সংরক্ষণাগার। বিশেষ করে কাবাকেন্দ্রীক প্রতিটা জিনিস এখানে সংরক্ষিত আছে।
জাদুঘরে প্রবেশের মুখে রাখা হয়েছে ২০৫০ সাল নাগাদ বর্তমান সৌদি সরকারের মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে কেমন হবে মসজিদে হারাম ও মক্কার অবয়ব। তবে এখানে শুধুমাত্র মক্কা নয় বরং মক্কাসহ মদিনা সভ্যতারও অনেক কিছু সংরক্ষণ করা আছে।
Master Plan For Makkah City And Masjid Al Haram BY 2050
বিশ্বের এক অনন্য নিদর্শন হলো জমজম কূপ। আরবি ভাষায় জমজম শব্দের অর্থ ‘ অঢেল পানি’। মক্কা জাদুঘরে রয়েছে ১২৯৯ হিজরি সনের জমজম কূপের একটি নিদর্শন এবং জমজম কূপের থেকে পানি উত্তোলনের পুরনো যন্ত্রপাতি, জমজম কূপের পানি বিতরণের চিত্রও সংরক্ষিত রয়েছে অতি যত্নে।
Ancient Zam Zam Kup
এছাড়াও রয়েছে প্রাচীন আমলের অনেকগুলো পবিত্র কোরআনের কপি যা অত্যন্ত সুন্দরভাবে কাচের ঘরে সংরক্ষণ করা হয়েছে। জেনে আশ্চর্য হবেন যে, অপূর্ব সুন্দর কারুকাজ এবং রকমারি ডিজাইনের লেখা স্বর্ণ ও রুপার রংমিশ্রিত কালিতে এসব লেখা কিন্তু কোন প্রেস বা কম্পোজ করা নয়।
সবচেয়ে পুরাতন কোরনের কপি
সবই হাতে লেখা যদিও আপনার দেখে তা মনে হবে না। সাথে এক দৃষ্টিতে থাকলেও আপনার মুগ্ধতার রেশ কাটবে না। এসব কোরআনের কপিগুলো খুবই প্রাচীন কোনোটি ৩৮১ হিজরি সনের, আবার কোনোটি ৬৮৫ সনের।
তবে মক্কা জাদুঘরের সবচেয়ে দামী সংগ্রহ হলো- কোরআন মাসহাফে উসমানির একটি কপি যা হজরত উসমান (রা.)-এর আমলের হাতে লেখা।
খলিফা হযরত উসমানের (রাঃ) সময়ের পবিত্র কোরআন
মক্কা জাদুঘরে ঘুরতে ঘুরতে একসময় দেখতে পাবেন কাবা ঘরের স্থাপনায় ব্যবহৃত বিভিনন্ন সময়ের নানারকম স্থাপত্য শৈলীর অনেক নমুনা,আরবী আয়াত উৎকীর্ণ পাথর খণ্ড, প্রাচীন কাবা শরীফের বিবর্তনকালের অনেক ছবি রয়েছে।
বেশ কিছু ক্যালিওগ্রাফিও অত্যন্ত সুন্দর ভাবে দেয়ালে সাজানো রয়েছে যা প্রাচীন মুসলিম সভ্যতার ঐতিহ্যবাহী নিদর্শন হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়েছে।
এছাড়াও সংরক্ষণ করা আছে প্রাচীন কাবা ঘরের ব্যবহৃত দু’টি কাঠের দরজা, আরো আছে ৯৬৬ হিজরি সনে কাবার দরজার বিশেষ নকশা যা অটোম্যান শাসক সুলতান সোলাইমান বিন সালিম খাঁন দিয়েছিলেন।
আগের দিনের মিনারের ডিজাইন, কাবার অভ্যন্তরের কাঠের বাক্স যা ১৪০৪ হিজরি সনে ব্যবহৃত হয়েছিলো।
আরো আছে কাবার গিলাফ (যদিও প্রতি বছর কাবা শরীফের গিলাফ পরিবর্তন করা হয় এখানে প্রাচীন একটি গিলাফ দেখতে পারবেন), হাতে কাবার গিলাফ বুননের যন্ত্র, কাবার ভেতরে ব্যবহৃত কাঠের খুঁটি যা ৬৫ হিজরি সনে ব্যবহৃত হয়েছিলো এবং নির্মাণ করেছিলেন আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের।
কাবার গিলাফ
পবিত্র পাথর হাজরে আসওয়াদ বা কালো পাথর সংরক্ষণের জন্য বানানো রূপা দ্বারা নির্মিত বিশেষ ফ্রেম রয়েছে।
হাজর এ আসওয়াদ বা কালো পাথর
আরো দেখতে পাবেন কাবার ছাদের পানি নিষ্কাষণের জন্য বিশেষ পাইপ।
১২৪০ সনে কাবায় ব্যবহৃত কারুকাজ সম্পন্ন বিশেষ সিঁড়ি যা কাঠ দিয়ে তৈরি।
কাবা ঘরের ভিতরের সিড়ি
অনেক দূর থেকে সময় দেখার প্রাচীন আমলের বিশাল ঘড়িও সংরক্ষণ করা আছে মক্কা জাদুঘরে।
মক্কা জাদুঘরের পাশে উম্মুল জুদ নামক একটি জায়গা আছে যেখানে কাবার গিলাফ তৈরির কারখানা স্থাপিত। স্থানীয় ভাষায় গিলাফ তৈরির কারখানাকে কিসওয়া কাবা বলা হয়। ১৩৯৭ হিজরি সনে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে গিলাফ তৈরির এই অসাধারণ কারখানাটি। যদিও এখানে সর্বসাধারণের প্রবেশের অনুমতি নেই। তবে বাইরে থেকেও অনেক কিছুই দেখে আত্নতৃপ্ত হওয়া যায়।
একটু সামনেই রয়েছে মক্কাভিত্তিক আন্তর্জাতিক সেবা সংস্থা রাবেতা আলম আল ইসলামি বা মুসলিম ওয়ার্ল্ড লীগ অফিস।